নিজস্ব প্রতিবেদক:
কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ ১১ খাতেই দুর্নীতি স্বাস্থ্য অধিদফতরে।
দুর্নীতিবাজকে রক্ষা করতে আরেক দুর্নীতিবাজ সহায়তা করছেন। এ কারণে আইনের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে দুর্নীতিবাজরা অব্যাহতি পাচ্ছেন। পার পেয়ে যাচ্ছেন মূল অপরাধীরা। শুধু এই সরকারের আমলেই নয়। সব সরকারের আমলে্ই এই খাতে দুর্নীতি চলছে।
স্বাস্থ্য খাতে মাফিয়া ডন বলে খ্যাত একাধিক শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য থামছেই না। তাদের লাগামহীন দুর্নীতি ও জালিয়াতির তদন্ত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। চার বছর ধরে এ বিষয়ে টুঁ-শব্দটি নেই। এমনকি দুদকের সুপারিশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ ঘোষিত ‘কালো তালিকাভুক্ত ১৪ ঠিকাদারের’ মধ্যেও তার নাম নেই। চুনোপুঁটিদের ‘কালো তালিকায়’ রেখে কার ছত্রছায়ায় তিনি বারবার বেঁচে যাচ্ছেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সর্বমহলে।
স্বাস্থ্য খাতে একজন দুর্নীতিগ্রস্ত পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাহলে তার খুঁটির জোর কোথায়? এমন প্রশ্ন অনেকের মাথায় ঘুরপাক খেলেও স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি থেমে নেই। শুধু এই দুই জন নয়, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজদের তালিকা অনেক লম্বা। এই স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে একটি চক্র বছরের পর বছর হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করলেও তাদের গডফাদাররা আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে। মেডিকেল কলেজে ভর্তি জালিয়াতি থেকে শুরু করে ডাক্তার-নার্স-টেকনিশিয়ান নিয়োগ-বদলি, হাসপাতালের কেনাকাটা স্বাস্থ্য-খাতের এমন কোনো দিক নেই যেটি দুর্নীতিতে জর্জরিত নয়। বিভিন্ন সময় অধিদফতরের কিছু কেরানী, ড্রাইভার আর সাহেদ-সাবরিনার মতো ফেঁসে যাওয়া ছোটখাটো পাতি নেতারা ধরা পড়লেও রথি-মহারথিরা থেকে যাচ্ছে আড়ালে। দুর্নীতিবাজ এসব গডফাদারদের না ধরা পর্যন্ত দুর্নীতির এসব ধারাবাহিক কাহিনী বন্ধ হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। মহামারি করোনায় চিকিত্সায় ব্যবহার্য সামগ্রী ক্রয়েও হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পিছপা হয়নি এসব দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সামান্য কয়েকশ টাকার পর্দা ও সুঁই-সিরিঞ্জের দাম কয়েক লাখ টাকা করে দেখানো, প্রশিক্ষিত অপারেটর না থাকার পরও দামি যন্ত্রপাতি কিনে ফেলে রেখে মেয়াদোত্তীর্ণ করে ফেলা কোনো ফাঁকফোকরই বাদ পড়ছে না দুর্নীতির করাল থাবা থেকে। দিনের পর দিন মিডিয়ায় স্বাস্থ্য খাতের নানা দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে বিভিন্ন কমিটির, এমনকি খোদ দুদকের সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।
অনেক দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে দুইবার তদন্ত হয়েছে, শেষ পর্যন্ত অব্যাহতি পেয়েছেন। আবার তদন্ত করে যাদের বিরুদ্ধে কিছু পাওয়া যায়নি, কিন্তু তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়নি।
নার্সিং সেক্টরে সর্বশেষ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডিপ্লোমাধারী নার্সদের নার্সিং কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত নিয়ে মোটা অঙ্কের লেনদেন হওয়ার অভিযোগ করেছেন নার্সিং সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
তারা বলেন, নার্সিং কাউন্সিল একটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে অভিযুক্ত দুই জনের একজনকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য, অপর একজনকে বদলি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু তাও কার্যকর হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, যে ব্যবস্থা নেবেন তিনিই ঘুষ খান। তাহলে কী করে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই।
বদলি, নিয়োগ ও কেনাকাটাসহ সব কিছুতেই চলছে দুর্নীতি। অধিদপ্তরের পাশাপাশি মন্ত্রণালয়েও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
তিনি বলেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে চাকরি ছেড়ে চলে যেতে হবে। কারণ এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, চেষ্টা করেও সত্ থাকা যায় না। কর্মচারীরাই কোটি কোটি টাকার মালিক। অবশ্যই এর শেষ হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসনে দুর্নীতি করলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ব্যবস্থা নেবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতির ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখানে দুর্নীতির কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মিলেমিশে খাওয়ার একটা প্রচলন চলে আসছে।
তিনি বলেন, নার্সিং কাউন্সিলও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যত্রতত্র নার্সিং ইনস্টিটিউটের অনুমোদন দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব ইনস্টিটিউটের ৯৫ ভাগেই নার্স তৈরি করার কোন অবকাঠামো নেই। বিএমএ ও নার্স নেতৃবৃন্দের দাবি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ স্বীকৃতপ্রাপ্ত কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ডাক্তার-নার্স ছাড়া অন্য কোন যত্রতত্র জায়গা থেকে নার্স তৈরি করে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার দায়িত্ব দেওয়া হবে, সেখানে ভুল চিকিৎসার হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, দুর্নীতি প্রশ্রয় দিলে বাড়তেই থাকবে। এতে অরাজকতার সৃষ্টি হবে। কেউ কারোর কথা মানবে না। যিনি ব্যবস্থা নেবেন, তিনিই দুর্নীতিগ্রস্ত।